আমাদের দেশে অনলাইন ব্যবসায় শুরু করার সময় কোন প্রোডাক্ট নিয়ে ব্যবসা শুরু করা উচিত তার একমাত্র এবং অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে, “যে প্রডাক্ট ভাল চলতেসে সেটা”। এই উক্তির পেছনে নেই কোন সংগঠিত রিসার্চ, নেই কোন কংক্রিট ডেটা। শুধুমাত্র লোকমুখে শুনে যে ব্যবসা ভাল চলছে মনে হচ্ছে সেই প্রোডাক্ট প্রথম চয়েসে পরিণত হয়। ভবিষ্যতে আদৌ এই প্রোডাক্ট চলবে কিনা, ডিমান্ড কেমন হবে, প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার কোন সুযোগ আছে কিনা এই ধরণের কোন বিশ্লেষণ করা হয় না। যে কারণে সবাই যে প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছে সেই প্রোডাক্ট নিয়ে শুরু হয় অনলাইন ব্যবসা।
ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় দেখেন। যখন কমন একটি প্রডাক্ট নিয়ে ব্যবসা শুরু করা হয় সেখানে আসলে নতুনত্ব আনার তেমন কোন সুযোগ থাকে না। সবাই যে স্টাইলে মার্কেটিং করছে, যে ধরণের অফার দিচ্ছে সেই একই রকমভাবে একই কাজ করে গড়ে উঠে নতুন নতুন পেইজ এবং ব্যবসায়। শুধু সেটা হলেও হত, আসল সমস্যা আসে প্রাইস এর ক্ষেত্রে।
আমাদের দেশের অনলাইন ব্যবসায়ের প্রাইসিং স্ট্রাটেজি একটাই। মার্কেটে যে দামে দিচ্ছে এর থেকে কমে দিব। এর বাইরে আর কোন প্রাইসিং স্ট্রাটেজি নিয়ে কেউ চিন্তার প্রয়োজন মনে করে না। অথচ আমরা যখন বিবিএ এমবিএ করি আমাদেরকে আরও বিভিন্ন ধরণের প্রাইসিং স্ট্রাটেজি শেখানো হয়েছে। যেমনঃ
- কস্ট প্লাস প্রাইসিংঃ আপনার প্রোডাক্টের খরচের উপর আপনি একটি মার্ক আপ সংযুক্ত করে প্রাইস সেট করবেন।
- কম্পেটিটিভ প্রাইসিংঃ কম্পিটিশন যে ধরণের প্রাইস চার্জ করছে সেটার মত প্রাইস সেট করা।
- প্রাইস স্কিমিংঃ প্রথমে অনেক বেশী দাম দিয়ে শুরু করা এবং মার্কেট বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে দাম কমিয়ে আনা।
- পেনেট্রেশন প্রাইসিংঃ কম্পিটিটিভ মার্কেট ঢোকার জন্য প্রাইসিং কমিয়ে রাখা এবং ধীরে ধীরে পরবর্তীতে প্রাইসিং বাড়িয়ে দেয়া।
- ভ্যালু বেসড প্রাইসিংঃ অর্থাৎ আপনার প্রডাক্ট বা সার্ভিসে এক্সট্রা ভ্যালু সংযুক্ত করুন এবং সেই অনুযায়ী প্রাইস রাখুন।
দুঃখজনক হলেও আমাদের দেশে অনলাইন ব্যবসায় এর প্রাইসিং স্ট্রাটেজি হচ্ছে “মার্কেট ধরার জন্য কম প্রাইসে দিব”, এই মার্কেট ধরতে গিয়ে আসলে মার্কেট নষ্ট হচ্ছে। কিভাবে? আসেন বলি।
তিনজন ব্যক্তির কথা চিন্তা করেন, তানিয়া, মাইশা এবং জান্নাত।
তানিয়া অনলাইন ব্যবসা করছে ২০১৭ সাল থেকে। আরলি শুরু করায় সহজেই তার অনলাইন ব্যবসায় বড় হতে সময় নেয়নি। প্রতিযোগিতা কম, মার্কেটিং খরচ কম এবং লেগে থেকে কাজ করে যাওয়ার কারণে একটি ভাল অবস্থানে চলে আসে তানিয়ার ব্যবসা। টিম বড় করে ছোট্ট একটা দোকানও নিয়ে নেন ভাল একটি শপিং সেন্টারে। শুধু এক ধরণের প্রোডাক্ট এর রমরমা ব্যবসা করতে থাকে তানিয়া। মনে করি তানিয়া যে প্রোডাক্ট বিক্রয় করে তার দাম ২,০০০ টাকা।
এখন ২০২০ সালে অনলাইন ব্যবসায়ে নামে মাইশা। অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপে দেখেছে অনলাইন ব্যবসা করে অনেক টাকা কামানো সম্ভব। সদ্য ভার্সিটি থেকে বের হয়েই ভেবেছে শুরু করবে নিজের অনলাইন বিজনেস। এবং অল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করবে তার ব্যবসা কারণ সে তো মাত্র স্টুডেন্ট। তাই অল্প কিছু প্রডাক্ট নেয় মাইশা, মার্কেটিং বাজেটও অল্প, বয়ফ্রেণ্ড বুস্ট করে দেয়ার আশ্বাস দেয়াতে মনে একটু বল আসে। নেই কোন দোকান, নেই কোন টিম; তাই মাইশা ভাবল দাম কমালেই “মার্কেট ধরা” সম্ভব হবে। তানিয়া যে প্রোডাক্ট ২,০০০ টাকায় বিক্রয় করে সেই একই প্রোডাক্ট মাইশা দাম কমিয়ে বিক্রয় করা শুরু করে ১,৫০০ টাকায়। এবং এখানেও সে স্বল্প প্রফিট করতে সক্ষম হয় কারণ তানিয়া যে বিনিয়োগ এবং যে বড় পরিসরে কাজ করে তার খরচ বাড়িয়ে ফেলেছে, মাইশার সেটা প্রয়োজন নেই। যে প্রডাক্ট আগে তানিয়া ২,০০০ টাকায় বিক্রয় হত, মাইশার কাস্টমার সেটা পাচ্ছে ১,৫০০ টাকায়।
দুই বছর পরে হাউজওয়াইফ জান্নাত নামেন ব্যবসায়ে। ছোট্ট দুই সন্তান এবং ব্যাংক এ চাকরিরত হাসবেন্ড নিয়ে তার ছোট সংসার। নিজের জমানো কিছু টাকা এবং হাসবেন্ড থেকে অল্প কিছু ব্যাক আপ নিয়ে শুরু হয় তার জান্নাত’স বুটিক্স। কিছুটা শখের বশেই নেমেছেন ব্যবসায়। নিজের একটা পরিচয় তৈরি হোক, প্রফিট আসলে আসল, না আসলে নাই। তাই মাইশা যে ধরণের প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে সেই ধরণের কিছু প্রোডাক্ট নিয়ে মার্কেট ধরার জন্য জান্নাত দাম রাখে ১,২০০ টাকা। যেহেতু তার প্রফিট সামান্য হলেই হবে, তাই দাম কমালেই মার্কেট পাবে বলে মনে করল জান্নাত। যে প্রডাক্ট আগে মাইশা ১,৫০০ টাকায় বিক্রয় হত, জান্নাতের কাস্টমার সেটা পাচ্ছে ১,২০০ টাকায়।
সাল ২০২৩, তানিয়ার অনলাইন ব্যবসা এখন আর আগের মত নেই। টিম এর খরচ, দোকান ভাড়া, মার্কেটিং খরচ সব দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কাস্টমার তার ইনবক্সে ম্যাসেজ দেয়, “আপু এই প্রোডাক্ট জান্নাত’স বুটিক্স পেইজে ১,২০০ টাকায় দেখলাম আপনারটায় বেশী কেন?” উত্তর নেই তানিয়ার কাছে!
উত্তর থাকবে কিভাবে? এভাবে মার্কেট ধরার নামে প্রোডাক্ট এর দাম কমানোর কারণে নষ্ট হচ্ছে অনেক প্রডাক্ট এর মার্কেট। এর প্রধান কারণ হচ্ছে না জেনে, না বুঝে, পরিকল্পনা ছাড়া, ট্রেন্ডে ঝাপিয়ে পরে অনলাইন বিজনেস খুলে ব্যবসায় করার চেষ্টা করার কারণে। যতদিন না আমরা দাম কমিয়ে মার্কেট ধরার টেন্ডেন্সি থেকে বের হতে পারব ততদিন আমাদের এফ কমার্স ফোকাসড অনলাইন বিজনেস এর কোন নিরাপত্তা নেই।
সবাই উদ্যোক্তা, সবাই মার্কেটার, তাহলে ক্রেতা কে? এখন তো পাইকারি বিক্রেতাও চলে আসছে রিটেইল সেল করতে। কিন্তু কেন?! আমাদের দেশে কোন পলিসি বা কাঠামো নেই, হবে কিনা জানিনা, তাই ব্যবসায়ীদের উচিত নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে দাম কমিয়ে মার্কেট ধরার প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হবে। এবং সবাই মিলে এক প্রোডাক্ট এর সেল করার জন্য উঠে পরে লাগলে হবে না। আজকে আপনি দাম কমিয়েছেন, কালকে আরেকজন কমাবে এভাবে নষ্ট হবে আপনাদের প্রোডাক্ট এর মার্কেট।
মার্কেট এ যে প্রাইস আছে, সেরকম কাছাকাছি প্রাইস রাখুন। মার্কেটিং এর ধরণ, অফার, পরিবেশন ইত্যাদির মাধ্যমে কাস্টমার ধরার চেষ্টা করুন। কারণ আমাদের ক্রেতারা খুবই প্রাইস সেনসেটিভ। যেটা কমে পাবে সেটাই নিবে, প্রয়োজনে পরে পস্তাবে তাও আগে বেশী টাকা দিবে না, সুতরাং তাদেরকে এই সুযোগ যত কম দিবেন আপনার বিজনেস এর জন্য তত ভাল হবে।
মার্কেট ধরতে গিয়ে মার্কেট নষ্ট করবেন না। জানুন, বুঝুন তারপর ব্যবসায় নামুন।
পুরো লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
নাফিস কাওসার, ফাউন্ডার – Continto
Add a Comment